Wednesday 10 January 2018

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও ইসলামী ভাবনা

১লা মে আমাদের মাঝে প্রতি বছর ফিরে আসে। তবে অন্যান্য তারিখের মতো করে নয় একটু ভিন্নভাবে। ফিরে আসে হাহাকার নিয়ে, মেহনতি মানুষের কাজের দাবি নিয়ে, তাদের কাজের যথাযথ স্বীকৃতি নিয়ে। কিন্তু তাদের যথাযথ মর্যাদা কি আমরা দিতে পেরেছি? আমরা কি তাদেরকে মানুষের কাতারে রাখছি শুধুমাত্র কিছু আনুষ্ঠনিকতা ছাড়া? তবুও ১লা মে এর আনুষ্ঠানিকতা কম কিসে! আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শ্রমিক দিবস (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ডড়ৎশবৎং উধু) হিসেবে পরিচিত ১ল মে শ্রমজীবী মানুষের কাজের স্বীকৃতির দিনটি ১৮৯০ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনের মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে পালন করে শ্রমিক দিবস। শ্রমিক দিবস তথা মে দিবস খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের ঘর্মাক্ত প্রতিচ্ছবির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মনে করিয়ে দেয় তাদের রক্তাক্ত ইতিহাসের যে ইতিহাসের আনুষ্ঠানিকতা আছে কিন্তু তার কোন যথাযথ বাস্তাবায়ন নেই।

মে দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১২৭ বছর আগের শ্রম ইতিহাস। তখনও সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্থ ১২ ঘন্ট বা তার  চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হতো শ্রমিকদেরকে। হারভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়ে ভাগ্যে জোটতো শোষণ-নিপীড়ন বঞ্চনা। সীমাহীন নির্যাতন, স্বল্প মজুরী মানবিক অধিকারহীনতা প্রভৃতি নিয়ে যেখানে একা একাই টিকে থাকা কষ্ট সেখানে রয়েছে পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ। অন্যদিকে শ্রমিকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে গড়ে ওঠতো পুঁজিপতি শ্রেণীর সম্পদের পাহাড়। এসবের বিরোদ্ধে আমেরিকাতে প্রথমবারের মতো প্রতিবাদ ওঠে ১৮৮৪ সালের অক্টোবর, যার মূল দাবি ছিল ১২ঘন্টার পরিবর্তে ঘন্টা শ্রম। কিন্তু দাবিতে কার যায়-আসে? ফেডারেশন অব লেবার এর দাবিতে কোন মালিকশ্রেণীতো কর্ণপাত করলইনা বরং তারা শ্রমিক নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। ফলে এক সময় শ্রমিকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের আকার ধারণ করল। বিস্ফোরণমুখ এরুপ পরিস্থিতিতে কাজের সময় ১২ ঘন্টার পরিবর্তে ঘণ্টা নির্ধারণ করা, মজুরির পরিমাণ বাড়ানো এবং কাজের উন্নত পরিবেশ তৈরি করাসহ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষে ১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শিল্পশ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় শ্রমিকদের কাছ থেকে। ধর্মঘটে যোগ দেন লাখ শ্রমিক। তারা কলকারখানা বন্ধ রেখে নেমে এলেন রাজপথে। মালিকশ্রেণীর শোষণের বিরোদ্ধে গড়ে ওঠা ধর্মঘটকে সহজভাবে নেয় নি সমাজপতিরা। তারা তাদের নির্যানতনকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষে প্রশাসনেকে আহবান করে ধর্মঘট মোকাবিলা করার জন্য। মালিকদের প্রত্যক্ষ মদদে প্রশাসন শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে হামলা চালায়। ধর্মঘটে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মে একই স্থানে শ্রমিকদের সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শ্রমিকরা যোগ দেয়।  মালিকশ্রেণী শ্রমিকদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য হীন স্বড়যন্তে মেতে ওঠে। তারা তাদের সন্ত্রাসীদেরকে লেলিয়ে দিয়ে বোমা হামলা করে পুলিশ সদস্যকে মেরে ফেলে যার খেসারত আবার শ্রমিকদেরকে দিতে হয়। প্রশাসন শ্রমিকদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালায় এতে ১১জন শ্রমিক মারা যায়। শ্রমিক নেতৃবৃন্দসহ অসংখ্য শ্রমিকের নামে মামলা করা হয়। আটক করা হয় অনেক শ্রমিক নেতাকে। শুধু তাই নয় অভিযুক্তদেরকে বিচারের নামে সাজানো হয় নাটক। প্রহসণের বিচারের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিকনেতাসহ ফাঁসি কার্যকর করা হয় জনের। এতকিছুর পরও শোষণের বিরোদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায় নি। তা ছড়িয়ে পড়ে সার দুনিয়ায়। শিকাগোর রক্তাক্ত ঘটনার উত্তাপ সকল যায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় ঘন্টা কাজের দাবি আদায় হয়।  শিকাগোর আন্দোলনের বছর পর ১৮৮৯ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসে রক্তঝরা শিকাগোর শহীদদের স্মরণ রাখার লক্ষে ১দিন সংহতি দিবস পালনে সিদ্ধান্ত হয় এবং ১লা মে দিন ঠিক হয়। ফলে ১৮৯০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা মে দিবসটিকে আন্তার্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।

বাংলাদেশে মে দিবস
বিশ্বয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও মে দিবসের ছোঁয়া লাগে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলেই। ১৯৩৮ সালে নারায়নগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান আমলে দিবসটি পালন করা হলেও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার মাধ্যমে মে দিবস পালন করা হয় এবং বছরই সরকারী ছুটি ঘোষণা মে দিবসকে পালন করার আবহকে বাড়িয়ে দেয়। আজপর্যন্ত মে দিবস বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্নভাবে পালন করে যাচ্ছে।

ইসলামে শ্রমের মর্যাদাঃ
শ্রম আন্দোলনের দীর্ঘ ১২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমজীবী মানুষদের মুক্তি মিলেছে এরকম কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় নি এখনও। ঘন্টা কাজের নিয়ম প্রতিষ্ঠা হলেও শ্রমজীবী মানুষরা তাদের অধিকার সত্যিকার অর্থে ফিরে পায় নি। থামেনি নিপীড়ণ, অত্যাচার, জুলুম নির্যাতন। প্রতিষ্ঠিত হয় নি মালিক শ্রমিক কল্যানমূলক সম্পর্ক। তবে দেড়হাজার বছর পেছনে তাকালে দেখা যাবে একমাত্র ইসলামই শ্রমিকের যথাযথা মর্যাদা অধিকার উপলব্ধি করতে পেরেছিল এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হয়েছিল। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তিনি যে ঐশ্বরীক বিধান চালু করেছিলেন তাতে শ্রমিক শ্রমের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর অমোঘ বাণী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অতুলনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।তোমরা যা খাবে তা তাদেরকেও খাওয়াবে তোমরা যা পরবে তা তাদেরকেও পরতে দেবে বলে যে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। কোন দার্শনিক তার লোকদের জন্য এরকম কথা বলার সাহস পান নি।  শ্রমজীবী মানুষেরা সমাজের বিচ্ছিন্ন কোন অংশ নয় বরং তার সে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ ব্যাপারেও মুহাম্মদ (সা:) এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এরকম যে -‘যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে ব্যাবহারে নমনীয় হওয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন-‘তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোন রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যেতোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না। শ্রমিকের মজুরির বিষটির পূর্বেই আসে তার মানবিক অধিকারের বিষয়টি। ব্যাপারেও তিনি উদাসি ছিলেন না বরং শ্রমিকের মানবিক দিক বিবেচনায় তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করে বলেছেন- ‘মজুরদের সাধ্যের অতীত কোন কাজ করতে তাদের বাধ্য করবে না। অগত্যা যদি তা করাতে হয় তবে নিজে সাহায্য কর। মালিকের প্রতি শ্রমিককে তার অধিকার নিশ্চিত না করার পরিণাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহানবী (সা) কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরোদ্ধে আমি কঠিন অভিযোগ উপস্থাপন করব-যে ব্যক্তি আমার কাউকেও কিছু দান করার ওয়াদা করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করল, যে কোন মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে তার মূল্য আদায় করল এবং যে ব্যক্তি অন্যকে নিজের কাজে নিযুক্ত করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিলো, কিন্তু তার মজুরি দিলো না-ওরাই সেই তিনজন। শ্রমিকের প্রতি মালিক যাতে সহনশীল থাকে এবং তার ভুলত্রুটি ক্ষমার মতো মহৎ মনের অধিকারী হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে আল্লাহর নবী (সা) এক হাদীসে বলেছেন, ‘মজুর চাকরদের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ। অসদাচরণকারী মালিকদেরকে সতর্ক করে মহানবী (সা) আরো বলেছেন, ‘অসদাচরণকারী মালিক বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। শ্রমিকের মজুরি আদায়ের ব্যাপারে মহানবী (সা) এর অতি পরিচিত এবং বিখ্যাত একটি উক্তি সম্পর্কে সবার জানা থাকার কথা। তিনি বলেছেন, ‘মজুরকে তার গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই মজুরি পরিশোধ করে দাও। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা) এর এই বাণী শ্রমিকের মর্যাদার বিষয়টিকে আরো বেশি মহীয়ান করেছে। এছাড়াও শ্রমিক যেন তার কাজে ফাঁকি না দেয় সে ব্যাপারে অনেকবার রাসূল (সা:) আলেকপাত করেছেন। এভাবে ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা অধিকার প্রতিষ্ঠার যে গ্যারান্টি দিয়েছে, তা দুনিয়ার মানুষের তৈরি করা আর কোনো মতবাদ বা দর্শন দেয়নি। আধুনিক বিশ্বের পুঁজিবাদী সমাজবাদী রাষ্ট্র দর্শনের কোনটাই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার মর্যাদার ন্যূনতম সমাধান দিতে  তো পারেইনি বরং জটিল সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্ঠায় নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব করেছে। ফলে এখনও শ্রমিক-মজুররা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মালিকের অসদাচরণ, কম শ্রমমূল্য প্রদান, অনপযুক্ত কর্ম পরিবেশ কাজ করতে বাধ্য করা সহ নানা বৈষম্য শ্রমিকের দুর্দশা মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে আছে।

অবশেষে বলা যায় শুধু শ্রমিক দিবস পালন করার মাধ্যমেই শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বর্তমানে যেভাবে শ্রমিক দিবস পালন করা হয় এভাবে পালনে শ্রমিকদের কোন লাভ নেই তা তে  দেখাই যাচ্ছে। যে অধিকার আদায়ের জন্য শিকাগোতে শ্রমিকরা জীবন দিয়েছিল তা বাস্তবে এখনও অধরাই রয়ে গেছে। আজও শ্রমিকরা পায়নি তাদের কাক্সিক্ষত পরিবেশ বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, যথাযথ মজুরি। শ্রমিকদের অধিকার প্রদান করতে হলে প্রয়োজন সুন্দর একটি মন একটি পরিবেশ এবং একটি সমাজ। যে সমাজ হবে ইসলামের আদলে যে সমাজ হবে মানবতার কল্যাণে সে সমাজ হবে মানুষের জন্য। আসুন আমরা সে সমাজের নাগরিক হই যে সমাজে কোন শ্রমিক নির্যাতিত হবে না কোন শ্রমিক তার প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত হবে না। যে সমাজে কোন শ্রমিক তার অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হবে না। সে প্রত্যাশায় শ্রমিক দিবস সফল হউক।

লেখক আব্দুল্লাহ আল মুজাহিদ

সভাপতি: বিতর্কধারা-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment